দল কি

দল কি

সাধারণ অর্থে দল বলতে বোঝায় যখন কিছু মানুষ নির্দিষ্ট কোনো উদ্দেশ্যে একত্রিত হয় এবং তাদের মধ্যে একটি সম্পর্কে তৈরি হয়। দল গঠনের মূলে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য থাকে। উদ্দেশ্যবিহীন কোনো জনগোষ্ঠীকে দল বলা যায় না। দলের সদস্যদের মধ্যে থাকবে পারস্পরিক নির্ভরতা ও উদ্দেশ্যের অভিন্নতা সম্পর্কে সচেতনতা। সংগঠিত জীবনযাপন করতে হলে প্রয়োজন দলগত জীবন বা গোষ্ঠী জীবন। পারস্পরিক ভাবের আদান প্রদান, আবেগ ও সংবেদনশীলতা রয়েছে এমন কতিপয় ব্যক্তির সমষ্টিকে গোষ্ঠী বলা হয়। দল হচ্ছে একাধিক ব্যক্তির সমষ্টি যারা একটি স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কর্ম সম্পাদন করে। যথা - পরিবার, রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দল ইত্যাদি। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গোষ্ঠীর সংজ্ঞা প্রদান করছেন। যেমন: 

সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার এবং পেজ বলেন, দল বলতে যেকোনো পরস্পর সম্পর্কিত মানবগোষ্ঠীকে বুঝায়। সমাজ মনোবিজ্ঞানী শেরিফ (Sherif) এর মতে, দল হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট মর্যাদা ও ভূমিকা সম্পন্ন এমন কিছু লোকের সমষ্টি যাদের আচরণ ও বিশ্বাসকে নিয়ন্ত্রিত করার মত অভিন্ন মূল্যবোধ ও রীতিনীতি রয়েছে। সমাজবিজ্ঞানী জিসবার্ট বলেন, সামাজিক গোষ্ঠী হলো পরস্পরের সঙ্গে ক্রিয়াশীল এবং একটি স্বীকৃত কাঠামোর আওতায় জনসমষ্টি।

সমাজবিজ্ঞানী স্মল দলের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “দল হচ্ছে ক্ষুদ্র বা বৃহৎ একটি জনসমষ্টি যার মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে এমন একটি সম্পর্ক, যা দলের সদস্যদেরকে একই সূত্রে গ্রোথিত করে।” 

সমাজবিজ্ঞানী রবার্ট মার্টনের মতে, দল হচ্ছে এমন কিছু লোকের সমষ্টি যারা একে অপরের সঙ্গে স্বীকৃত ও নির্দিষ্ট ধারায় মিথস্ক্রিয়ায় রত হয়; যারা মনে করে, তারা একটি দলের অন্তর্ভুক্ত এবং যাদেরকে অন্যরা ভিন্ন দল মনে করে। 

উল্লিখিত সংজ্ঞাগুলো বিশ্লেষণের মাধ্যমে বলা যায়, দল হল দুই বা তার অধিক ব্যক্তির সমষ্টি যারা দলে অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তি, বস্তু ও ঘটনা সম্পর্কে অভিন্ন ধারণা পোষণ করে এবং তাদের সামাজিক ভূমিকা পারস্পরিক সম্পর্কের উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ দলের অন্তর্ভুক্ত ব্যাক্তিবর্গের আপন দল সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে এবং যখন কতকগুলি অভিন্ন স্বার্থ তাদেরকে পরিচালিত করবে তখনই তাকে দল বলা যাবে।


দলের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Group) 

নিম্নে দলের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ কর হলো:

১। দল হলো সমাজ জীবনের ভিত্তি। 

২। দলের অন্তর্ভুক্ত প্রত্যেক সদস্যের মনেই নিজেকে ও অপরকে আপন দলের একজন সদস্য বলে গণ্য করার মনোভাব থাকবে।। 

৩। ব্যক্তিবর্গের চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যেই দল গঠিত হয়। উদ্দেশ্যহীন জনসমষ্টিকে দল বলা যায় না। 

৪। দল এমন কিছু মানুষের সমষ্টি যাদের মধ্যে সমাজ স্বীকৃত পন্থায় মিথস্ক্রিয়া থাকবে।

৫। দলের সদস্যদের মধ্যে আমরা মনোভাব (we feeling) এর অস্তিত্ব অপরিহার্য। 

৬। দল মোটামুটি স্থায়ী ও অবিচ্ছিন্ন। ৭। দলের সদস্যদের মধ্যে গোষ্ঠী চেতনা থাকবে। 

৮। দলের অন্তর্ভুক্ত সদস্যদের মধ্যে আদর্শগত মিল, আচরণ ও কর্মকান্ডে অভিন্নতা উহার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। 

৯। দলের সদস্যগণের মধ্যে নিজ দলের অখণ্ডতা সম্পর্কে সামগ্রিক চেতনার সৃষ্টি করে। 

১০। দলবদ্ধ হয়ে জীবন যাপনা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। মানব জীবনের আদিম পর্যায় থেকেই মানুষ তার সমমনাদের সঙ্গে দল গঠন করে যৌথ জীবন যাপন আরম্ভ করে । 

উপরের বৈশিষ্ট্যগুলোকে অনুধাবন করে বলা যায় যে, দল হচ্ছে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এমন কিছু ব্যক্তিসমষ্টি যারা অভিন্ন উদ্দেশ্যে সামাজিক সম্পর্কে আবদ্ধ এবং যারা বিধিবদ্ধ নিয়ম শৃংখলা দ্বারা পরিচালিত।


দলের ধরন (Types of Group) 

উদ্দেশ্য এবং ব্যক্তিবর্গের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে দলের শ্রেণিকরণ করা হয়। সমাজবিজ্ঞানী সামনার তাঁর Folkways নামক গ্রন্থে দলকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা: 

১। অন্তঃদল (In-group) 

২। বহিঃদল (Out-group) 

উক্ত দু'ধরনের দলকে আমাদের দল' (We group) এবং অন্য দল' (Other group) ও বলা হয়ে থাকে। যেমন- যারা উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তারা নিজেদেরকে অন্তঃদলের সদস্য এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে বহিঃদলের সদস্য বিবেচনা করতে পারে। 

সমাজবিজ্ঞানী কুলী তার Social Organization নামক গ্রন্থে দলকে দু'ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা

১। মুখ্য দল (Primary group) ও 

২। গৌণ দল (Secondary group) 


১। মুখ্য দল: মুখ্য দলের সদস্যদের মাঝে থাকবে গভীর সহানুভূতি ও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক। মুখ্য দলের সদস্যরা নিবিড় সম্পর্কে আবদ্ধ। এটাকেই সমাজবিজ্ঞানী কুলী বলেছেন অন্তরঙ্গ সম্পর্ক (face to face relation)। তিনি কেবল পরিবারকেই মুখ্য দল বলে অভিহিত করেছেন। আর অন্যান্য সকল দলকে তিনি বলেছেন গৌণ দল। তাঁর মতে, রাষ্ট্র একটি গৌণ দল। মুখ্য দলের সদস্যদের মনের মধ্যে আমরা মনোভাব' (we feeling) বিদ্যমান থাকে। মুখ্য দল সকল সামাজিক প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্র বিন্দু। এই দলের মধ্যেই মানুষ সবচেয়ে বেশী ব্যক্তিগত জীবন যাপন করে থাকে এবং এক্ষেত্রে মানুষের সামাজিক সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। 


২। গৌণ দল: গৌণ দল হল বৃহত্তর সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত একটি জনসমষ্টি যেখানে একে অপরের সাথে পরোক্ষভাবে সংযোগ রক্ষা করে চলে। এখানে প্রত্যক্ষ সম্পর্কের অনুপস্থিতি লক্ষ করা যায়। গৌণ দল কতকগুলো রীতিনীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে গঠিত হয়, যেমন- ট্রেড ইউনিয়ন, শিক্ষক সমিতি ও ছাত্র সংগঠন ইত্যাদি। গৌণদলে অধিকার ও কর্তব্যবোধ থাকে নির্দিষ্ট। এই দলের সদস্যদের দল সম্বন্ধে সচেতনতা ও ঐক্যবোধ থাকলেও এখানে সবকিছু প্রত্যক্ষ কিংবা ব্যক্তিগত সম্পর্কের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় না। এধরনের দলে আনুষ্ঠানিক তথা সাংগঠনিক বৈশিষ্ট্যের প্রাধান্য থাকে।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Contact form

নাম

ইমেল *

বার্তা *