Home » » সম্প্রদায় কি

সম্প্রদায় কি

সম্প্রদায় কি / সম্প্রদায় কাকে বলে

সম্প্রদায় (Community)

সমাজবিজ্ঞানে সমাজের পরেই যে প্রাথমিক প্রত্যয়টি বিশেষভাবে আলোচিত হয় তা হলো সম্প্রদায়। ‘সম্প্রদায় হচ্ছে অভিন্ন সামাজিক রীতিনীতি পালনে অভ্যস্ত জনসমষ্টি যেখানে জীবনের সামগ্রিক প্রয়োজন মিটানো সম্ভব হয়। মানুষ তার প্রয়োজনেই সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করতে শিখেছে। সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্বিক বৈশিষ্ট্যের কারণে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে। তাই সম্প্রদায় বলতে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাসকারী জনসমষ্টিকে বুঝায়, যারা অভিন্ন রীতিনীতি অনুসরণের মাধ্যমে জীবনযাপন করে। 

সম্প্রদায়ভুক্ত লোকেরা সুনির্দিষ্ট আচরণের ভিত্তিতে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। সম্প্রদায় হচ্ছে এমন একটি সামাজিক ব্যবস্থা যেখানে সমাজের একটি বৃহত্তর গোষ্ঠী কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাস এবং অভিন্ন মানসিকতা ধারণ করে। সম্প্রদায়ের মধ্যেই ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ জীবন যাপন সম্ভব। সম্প্রদায়ের সদস্যরা সুস্পষ্ট সামাজিক সংহতি অনুভব করে এবং অভিন্ন জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত। 

সম্প্রদায়ের সংজ্ঞায় সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার ও পেজ বলেন, "Whenever the members of any group, small or large, live together in such a way that they share, not this or that particular interest but the basic conditions of common life called that group a community." যখনই কোনো ক্ষুদ্র অথবা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর লোকেরা এমনভাবে একত্রে বসবাস করে তারা বিশেষ কোনো স্বার্থের অনুসারী না হয়ে বরং অভিন্ন জীবনের অংশীদার হয়ে বসবাস করে আমরা তখনই ঐ জনগোষ্ঠীকে একটি সম্প্রদায় বলি। 

সমাজবিজ্ঞানী কিংসলে ডেভিস সম্প্রদায়কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন “সদ্ৰায় হল একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের বা স্থানের জনগোষ্ঠী যারা সকলেই একই সামাজিক রীতিনীতি মেনে চলে”। 

সমাজবিজ্ঞানী অগবার্ণ ও নিমকফ সম্প্রদায় বলতে এক বা একাধিক গোষ্ঠীর সমষ্টিকে বুঝিয়েছেন- যারা একই এলাকায় বাস করে (Community is a group or a collection of groups that inhabits a locality)। অগবার্ণ ও নিমকফের মতে, অভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী জনসমষ্টি অন্য এলাকার একটি জনসমষ্টি থেকে পৃথক। তদুপরি সম্প্রদায়ের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, অভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যমান সংগঠিত জীবন প্রণালী।

সমাজবিজ্ঞানী পার্ক ও বার্জেস বলেন “সম্প্রদায় বলতে এমন একটি আঞ্চলিক জনসমষ্টিকে বুঝায় যারা ভাষা, সামাজিক রীতিনীতি, ভাবধারা এবং দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে এক ও অভিন্ন”। 

অতএব, সম্প্রদায় বলতে এমন একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বসবাসকারী জনসমষ্টিকে বুঝায় যারা কোনো বিশেষ স্বার্থের জন্য কাজ না করে বরং একটি অভিন্ন জীবনযাত্রার অংশীদার হয়ে একত্রে বসবাস করে। সম্প্রদায়ভুক্ত লোকেরা অভিন্ন সংস্কৃতি ও সুনির্দিষ্ট আচার আচরণের ভিত্তিতে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।


সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Community) 

সম্প্রদায়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এর সদস্যদের অভিন্ন জীবন-যাপন প্রণালী ও মানসিকতা। একজন মানুষের সমগ্র জীবন একটি সম্প্রদায়ের মধ্যেই অতিবাহিত হয়। কোনো ক্ষুদ্র বা বৃহৎ গোষ্ঠীর সদস্যরা যেখানেই বসবাস করুক না কেনো একত্রে বসবাস করতে গিয়ে তারা জীবনের মৌলিক এবং সাধারণ স্বার্থগুলো একইসাথে ভোগ করে। এভাবেই গড়ে ওঠে সম্প্রদায়। সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরে একজন ব্যক্তির পরিপূর্ণ সামাজিক জীবন প্রতিফলিত হয়। ম্যাকাইভার ও পেজের মতে সম্প্রদায়ের ভিত্তি হল দুটি। যথা :

১। বসবাসের অঞ্চল (Locality) 

২। সম্প্রদায়গত চেতনা (Community sentiment) 

১। বসবাসের অঞ্চল: যেকোনো সম্প্রদায় সর্বদাই একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় বসবাস করে থাকে। সম্প্রদায়ের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের গুরুত্ব লক্ষ করা যায়। ভৌগোলিক পরিবেশের ক্ষেত্রে তারতম্যের জন্য মানুষের জীবনযাত্রায়ও পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। একটি নির্দিষ্ট এলাকায় দীর্ঘকাল বসবাসকালে মানুষের দৈহিক, মানসিক ও আচার-আচরণ, রীতিনীতি ইত্যাদিতে একটা সামঞ্জস্য গড়ে ওঠে। এই সামঞ্জস্যের ভিত্তিতে গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের মধ্যে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। যেমন - এস্কিমো সম্প্রদায়, গ্রাম সম্প্রদায়, পাহাড়ী সম্প্রদায় আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের দ্বারা চিহ্নিত। 

২। সম্প্রদায়গত চেতনা: একটি সম্প্রদায়ভুক্ত সকল সদস্যের একসাথে বসবাস করার মানসিকতা থাকতে হবে। একই সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সংহতিবোধ খুবই প্রবল এবং তারা সবাই পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সচেতন। এর অর্থ হচ্ছে এই যে, সম্প্রদায়গত অনুভূতিই একটি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন ব্যক্তি, পারস্পরিক সম্পর্ক ও সচেতনতার পরিচায়ক। বস্তুত, একই সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে ভাবগত, আচরণগত এবং রীতিনীতিগত বৈশিষ্ট্যের সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। এছাড়াও সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য হিসেবে সাংস্কৃতিক ঐক্য ও সাদৃশ্য, ঐতিহ্য, নৈকট্য ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।


সম্প্রদায়ের ধরন (Types of Community) 

সম্প্রদায় ছোট হতে পারে, আবার বড়ও হতে পারে। উভয় ধরনের সম্প্রদায়ই মানুষের প্রয়োজন। তবে বৃহত্তর সম্প্রদায় ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের অস্তিত্বকে কখনো কখনো বিলীন করে দিতে পারে। ব্যাপক অর্থে সম্প্রদায়ের দুটি ধরন রয়েছে। যথা:

১। গ্রামীণ সম্প্রদায়

২। শহুরে সম্প্রদায় 


গ্রামীণ সম্প্রদায়:

গ্রামীণ সম্প্রদায় হচ্ছে এমন একটি জনগোষ্ঠী যারা একই ভৌগোলিক অঞ্চলে বসবাস করে এবং যাদের মধ্যে পারস্পরিক পরিচিতি ও সম্পর্ক অত্যন্ত প্রত্যক্ষ ও নিবিড়। আদিম কৃষিভিত্তিক জীবনব্যবস্থা থেকেই গ্রামীণ বসতি গড়ে উঠেছে। যেসব এলাকায় গ্রামীণ বসতি গড়ে উঠেছে সেসব এলাকার সুনির্দিষ্ট নাম ও সীমারেখা রয়েছে। তবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আচার-আচরণ ও জীবনব্যবস্থা নগরের জনগোষ্ঠীর আচার আচরণ ও জীবনধারা থেকে ভিন্ন। নিম্নে গ্রামীণ সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ করা হল:

১। গ্রামীণ সম্প্রদায়ের সকলের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকে। 

২। গ্রামীণ সম্প্রদায়ের প্রধান পেশা সাধারণত কৃষি। এছাড়া পশুপালন, ক্ষুদ্র ব্যবসা সনাতন পেশাও পরিলক্ষিত হয়। 

৩। সাধারণত গ্রামীণ সম্প্রদায়ের লোকজন রক্ষণশীল থাকে এবং ঐতিহ্যগত মূল্যবোধের প্রতি অধিকার শ্রদ্ধাশীল। 

৪। গ্রামীণ সম্প্রদায়ের ভেতর সামাজিক গতিশীলতা কম। এখানে সামাজিক পদমর্যাদার গুরুত্ব বেশি। 

৫। গ্রামীণ সম্প্রদায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্ষুদ্রকায়। কারণ গ্রামগুলোর ক্ষুদ্র আয়তনের জন্য গ্রামীণ সম্প্রদায়গুলো ক্ষুদ্র হয়। 

৬। গ্রামীণ সম্প্রদায়ের লোকজন সামাজিক প্রথা ও রীতিনীতির প্রতি গভীর আস্থাশীল এবং মেনে চলে । 

৭। গ্রামীণ সম্প্রদায়ে অনানুষ্ঠানিক সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে কঠোর। 


শহুরে সম্প্রদায়: 

জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে এবং আর্থ-সামাজিক কারণে গ্রামের মানুষ শহরে বসতি স্থাপন করে। শহর জীবনে রয়েছে বৈচিত্র্য। এখানে সাধারণত কৃষিবহির্ভুত পেশার আধিক্য রয়েছে। সাধারণত ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা, সংস্কৃতি ও বিনোদন, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে শহর গড়ে ওঠে। শহুরে সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে: 

১। শহুরে শিক্ষার সুযোগ বেশি। এখানে বিচিত্র সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিলক্ষিত হয়।

২। শহুরে সম্প্রদায়ের সামাজিক পরিবেশ উন্নত এবং আধুনিক বিশ্বের অগ্রগতির সাথে তাদের জীবন ধারা সম্পৃক্ত। 

৩। শহুরে সম্প্রদায়ের মধ্যে একক পরিবারের আধিক্য লক্ষ করা যায়। 

৪। শহুরে সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক গতিশীলতা বেশি। 

৫। শহুরে সম্প্রদায় শিল্পোৎপাদন এবং বৃত্তিমূলক পেশায় বেশি নিয়োজিত। 

৬। শহুরে সম্প্রদায়ের লোকজন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারী এবং তারা অনেকটা কুসংস্কার মুক্ত। 

৭। শহুরে সম্প্রদায় অর্থনৈতিক কার্যক্রমে বেশি গতিশীল, চিন্তা-চেতনায় অধিকতর প্রগতিশীল হয়।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Contact form

নাম

ইমেল *

বার্তা *